রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব ও অর্থনৈতিক সংকট
রাশিয়ার সামরিক বাহিনি সীমান্ত অতিক্রম করে ইউক্রেন আক্রমন করেছে মাত্র পনের দিন চলছে। তখন থেকেই অপ্রত্যাশিতভাবে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী দ্বারা তারা তীব্র বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছে। রাশিয়ার উদ্দেশ্য বড় বড় শহরগুলো দখল করা এবং ইউক্রেন সরকারকে হটানো তবে এখন পর্যন্ত তারা এতে সফল হয়নি। দুই পক্ষের মধ্যে বৈঠক ও মত বিনিময় হয়েছে কিন্তু তাতে এখন পর্যন্ত কোন রকম সমাধান বা সমঝোতা হয়নি। ইতিমধ্যে রাশিয়ান বাহিনী বড় বড় শহরগুলোর একদম কাছে এসে পড়েছে এবং এর ফলে ব্যপক সংখ্যায় মানুষ হতাহত হচ্ছে। এই যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ রাশিয়ার ব্যবসা বাণিজ্য, রাশিয়ান সরকারের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির উপর এক গুচ্ছ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এমনকি আন্তর্জাতিক লেনদেন সংস্থা (সুইফট) থেকে তাদের বাদ দেয়া হয়েছে এবং আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সংরক্ষিত ডলার জব্দ করা হয়েছে।
বর্তমান এই যুদ্ধের প্রভাব শুধুমাত্র রাশিয়া ও ইউক্রেনের উপর পড়বে না, বরং বিশ্ব অর্থনীতির উপর এক ধরণের সংকট তৈরী করবে। এ প্রেক্ষিতে বলা যায় একটি দেশের অর্থনীতিকে কখনই রাজনীতি থেকে আলাদা করা যায় না, অবশ্যই একটি আর একটির উপর ভুমিকা রাখে।
এই যুদ্ধের অর্থনৈতিক প্রভাব জানতে হলে আমাদের সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন ও তার পরবর্তী সময়ে একটু ফিরে দেখতে হবে। ইউক্রেনের চরম অর্থনৈতিক সংকটই ২০১৩ ২০১৪ সালে কিয়েভের কেন্দ্রীয় চত্বরে ময়দান অভ্যুথ্যানের সৃষ্টি করে এবং রাশিয়া সমর্থিত সরকারকে পদচ্যুত করে। ২০১৪ সালের সেই সংকট ইউক্রেনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা একেবারেই ভেঙে পড়েছে এবং গত বার বছরে ইউক্রেনের গড় মজুরি বাড়েনি।ইউক্রেনে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় নেমে এসেছে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর পূর্ব ইউরোপ ও খোদ রাশিয়ায় পুজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরে আসায়।সোভিয়েত ইউনিয়নের সাবেক উপ রাষ্ট্র গুলোর সবগুলিরই প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় অতীত সীমায় পুনরুদ্ধার করতে অনেক সময় লেগেছে। কিন্তু ইউক্রেন কখনই তার প্রবৃদ্ধি ১৯৯০ সময়কালীন সেই মাত্রায় পৌছাতে পারেনি। ইউক্রেনের প্রবৃদ্ধি নিচের দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে থাকা কঙ্গো, বুরুন্দি এবং ইয়েমেনের মত অবস্থানে রেখেছে।
IMF ২০১৪ পরবর্তী ময়দান বিপ্লবের সরকারের কাছে চাইছে , সক্ষমতা বৃদ্ধি ও দুর্ণীতি মুক্ত করার জন্য ইউক্রেনের ব্যাংক ও রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠানগেুলোর বেসরকারিকরন। এক্ষেত্রে বড় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছে ইউক্রেনের কৃষি জমিগুলোর মালিকানায় ফিরিয়ে দেওয়া। সমগ্র পৃথিবীর এক চতুর্থাংশ উর্বর কালো মাটি রয়েছে ইউক্রেন জুড়ে। দেশটি ইতিমধ্যে পুথিবীর বৃহত্তম সূর্যমুখি তেল এবং চতুর্থ গম উৎপাদনকারী দেশের অবস্থানে পৌছেছে। ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় শহর খারকিভ ও পশ্চিমের টেরনোপিল পর্যন্ত সূর্যমুখি চাষের সাথে সাথে সয়াবিন ও গমের চাষ বিস্তার লাভ করেছে। কিন্তু কৃষি খাতে ইউক্রেনের উৎপাদনশীলতা খুবই নগন্য। যা ইউরোপের অন্যান্য দেশ যেমন পোলান্ড, জার্মানি ও ফ্রান্সের তুলনায় হেক্টর প্রতি চার থেকে পাঁচ গুণ কম। ইউক্রেনের মোট জনসংখার ৩০% লোক গ্রামে বাস করে এবং কৃষি খাত থেকে মোট জনশক্তির ১৪% কমংসংস্থান হয়।
সেভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯১ সালে ইউক্রেন স্বাধীনতা লাভ করার পরবর্তী সময়ে সেখানকার শাসক গোষ্ঠী ইউক্রেনের মানুষকে ব্যাপকভাবে লুটপাট চালায়। এরাই দেশটির সব সম্পত্তি ও কৃষি জমি জবর দখল করে আসছিল। এসব দুণীতি পরায়ন শাসকরা পুতিনের রাশিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন কর্তৃক সমর্থনপুষ্ট হয়ে বহাল তবিয়তে থাকত। কিন্তু রাশিয়ান সমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে ময়দান বিদ্রোহের পর থেকে ইউক্রেনের উগ্র জাতীয়তাবাদীরা সরকারি নীতিমালার উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে শুরু করে। এর ফলাফল স্বরুপ ইউক্রেনের স্কুলগুলোতে রুশ ভাষা শিক্ষা নিষিদ্ধ করা হয় এবং তারা ইউ তে যোগদানের দাবি জানায়, একই সাথে রাশিয়া কর্তৃক অধিগ্রহণ কৃত অঞ্চল পুনরুদ্ধারের জন্য ন্যাটোতে যোগ দেওয়ারও দাবী জানানো হয়। এমনকি এই দাবী ইউক্রেনের সংবিধানেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
নির্মম বাস্তবতা হল, রাশিয়ার আক্রমনের আগে অস্থিতিশীল ও দরিদ্র ইউক্রেন ইউ তে যুক্ত হোক তা জার্মানিও কোন ভাবে চায়নি। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও ইউক্রেনের ন্যাটোর সদস্য পদ লাভের বিষয়টি এড়িয়ে যেত। পক্ষান্তরে, কিয়েভ নিয়ন্ত্রিত রাশিয়ান ভাষাভাষী অঞ্চলের সায়ত্ব শাসন ছাড়া কোন রকম হস্তক্ষেপ করার ইচ্ছা মস্কোর ছিল না। রাশিয়া সব সময় ইউক্রেনের কাছে একটি স্থায়ী মতৈক্য চাইছিল যে তারা ন্যাটোতে যোগদান করবে না। প্রকৃতপক্ষে ইউক্রেন পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও রাশিয়ার পুজিবাদের স্বার্থের ফাঁদে পড়ে গেছে।
রাশিয়া যেহেতু যুদ্ধে নেমে পড়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের তৎপরতা শুরু করেছে । হোয়াইট হাউজে ই ইউ নেতা ভন ডের লিয়েন ও বাইডেন ঘোষণা দিয়েছেন, "আমরা রাশিয়ান ধনিক গোষ্ঠীর আর্থিক সম্পত্তি আমাদের বাজারে নিষিদ্ধ করতে কাজ করে যাব।" বাইডেন বলেছেন, "যুক্তরাষ্ট্র নাগরিত্ব বিক্রয়ের তথাকথিত গোল্ডেন পাসপোর্ট সীমিত করবে। এসব পাসপোর্ট এর মাধ্যমে সম্পদশালী রাশিয়ান নাগরিকরা সে দেশের সরকারের সাথে সংযুক্ত থেকে আমেরিকার নাগরিক হতে পারত। এর মাধ্যমে তারা আমেরিকার অর্থ ব্যবস্থার মধ্যে প্রবেশ করতে পারে।"
রাশিয়ার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও সরকার ডলার হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ার সম্ভাব্য ক্ষতি মোকাবেলার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। রাশিয়ার ব্যবসা বাণিজ্য ও আর্থিক লেনদেনে ডলারের সব রকম ব্যবহার বেশ জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। অর্থ মন্ত্রনালয় তেলের মজুদ তহবিলে আর কোন আমেরিকান ডলার দ্বারা মূল্যায়িত সম্পদ রাখছে না। রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিবিআর ডলারের মজুদ অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে । যেখানে প্রায় ২০% ইউরো এবং অল্প কিছু পরিমাণের রেনমিনবিকে (চীনের সরকারি মুদ্রা ) বিকল্প বিনিময় মুদ্রা হিসেবে নির্ধারণ করা হচ্ছে। অনেক রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক তাদের চুক্তিতে নিয়মিতভাবে একটা ধারা সংযুক্ত করে দিচ্ছে যে ডলারের মাধ্যমে লেনদেন করতে না পারলে অন্য যে কোন মুদ্রা দিয়ে লেনদেন করা যাবে। রাশিয়া তাদের নিজস্ব পেমেন্ট কার্ড 'মির' এবং সুইফট এর মত মেসেজিং সার্ভিস : "সিস্টেম ফর ট্রান্সফার অফ ফিনান্সিয়াল মেসেজ (SPFS) এর প্রসার ঘটাচ্ছে।রাশিয়ার প্রায় ২৩% স্বর্ণ মজুদ আছে, তবে এগুলো বাস্তবে ঠিক কোথায় রাখা হয়েছে তা অস্পষ্ট।
রাশিয়ার প্রধান প্রধান প্রযুক্তি পণ্যের উপর ধীর গতির নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে লক্ষ্য হল রাশিয়াকে বিশ্ব বাজারে চিপ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া। পদক্ষেপের ফলে ইন্টেল ও এনভিডিয়ার মত শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানকে চিপ সরবরাহ বন্ধ করেছে। রাশিয়ার উপর উচ্চ প্রযুক্তির সেমি কন্ডাক্টর মার্কেটে প্রবেশ এবং সামরিক বাহিনীর উন্নয়নের সরন্জাম আমদানির উপর নিশেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। অবশ্য চীনা যেসব প্রতিষ্ঠানের উপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আছে এমন সব কোম্পানি রাশিয়ার রপ্তানি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে। রাশিয়ার টেলিকম সরঞ্জামের বাজার উন্নয়নে হুয়াওয়ে ব্যবস্থা নিতে পারে।
লেখা: নজরুল জামিল
তথ্য সুত্র:
- Lenin, State and Revolution
- World Bank Development Report 2021
- https://thenextrecession.wordpress.com/2014/02/27/ukraine-hobsons-choice/
- https://www.imf.org/en/Publications/CR/Issues/2021/11/23/Ukraine-First-Review-Under-the-Stand-By-Arrangement-Requests-for-Extension-and-Rephasing-of-509855
- https://www.worldbank.org/en/news/opinion/2020/09/09/putting-people-in-control-of-their-land-to-realize-ukraines-potential
- https://worldhappiness.report/
- https://cebr.com/reports/the-new-voice-of-ukraine-conflict-with-russia-has-cost-ukrainian-economy-280-billion-since-2014-says-cebr/
- https://www.europeansanctions.com/2022/02/eu-adopts-targeted-and-sectoral-russia-sanctions/
- https://economicsofimperialism.blogspot.com/
No comments:
Post a Comment
to drop Your valuable Comment please mention your name (Click to arrow sign and select name/url)