রাশিয়া ও ইউক্রেনের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং চলমান যুদ্ধের প্রভাব
প্রকৃতপক্ষে রাশিয়ার অর্থনীতি "একটা চতুর ঘোড়া" যা শুধুমাত্র জ্বালানি ও প্রাকৃতিক সম্পদ রপ্তানির উপর নির্ভর করে টিকে আছে। এমন অর্থনীতি দুরবস্থার মধ্যে পতিত হয়, অর্থনীতিবিদগন এমন অবস্থাকে “ডাচ রোগ” বলে অভিহিত করেন। যেখানে এক দিকে প্রাকৃতিক সম্পদের রপ্তানি মুদ্রার মজুদ উদ্বৃত্ব করে তোলে, অন্যান্য পণ্যের বাণিজ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং অন্য দিকে অন্যান্য শিল্পের প্রতিযোগীতা হ্রাস করে। ২০১০ সালের প্রথম দিকে এমনটা ঘটেছিল । তখন তেলের উচ্চ মূল্য বৃদ্ধি রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের মজুদ ক্রমাগত ফুলে ফেঁপে ওঠে, যার ফলে অজীবাশ্ম জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ ব্যাপকভাবে কমে যায়। কিন্তু ২০১০ সাল থেকে রাশিয়ার অর্থনীতি এক জায়গায় স্থির হয়ে আছে। যদিও রাশিয়ার অর্থনীতি ২০১৪ সালের তুলনায় বৃহৎ। এবং এই সময়কার পুঞ্জিভুত জিডিপির প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক, কারণ ২০১৪ সালের চাইতে ২০১৯ সালে রপ্তানির পরিমাণ ১৭ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশ্ব ব্যাংক সব সময় সতর্ক করে আসছিল যে, রাশিয়াকে শুধু মাত্র প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ বাদ দিয়ে তাদের অর্থনীতির বৈচিত্র ঘটাতে হবে। এক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার উৎপাদনশীল শিল্প খাতে বিনিয়োগের সুযোগ করে দিতে পারত। যেটি রাশিয়ার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কারণে এখন আর সম্ভব নয়।
রাশিয়া যদি এই যুদ্ধে ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণ লাভ করতে পারে, সেক্ষেত্রে তারা উল্লেখযোগ্য কিছু সম্পদ করায়ত্ত করতে সক্ষম হবে। ইউক্রেন প্রাকৃতিক সম্পদ বিশেষ করে খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ একটি দেশ। ইউক্রেন বিশ্বের বৃহত্তম কমার্শিয়াল গ্রেডের লোহার আকরিক মজুদের অধিকারী। দেশটিতে ৩০ বিলিয়ন টন কমার্শিয়াল গ্রেডের লোহার আকরিক মজুদ আছে, যা সারা পৃথিবীর লোহার মজুদের পাঁচ ভাগের এক ভাগ। সমগ্র ইউরোপের মধে্য প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদে ইউক্রেন দ্বিতীয়। এই মজুদের একটা বড় অংশ এখন পর্যন্ত কোন কাজে লাগানো হয়নি। ইউক্রেনের বেশিরভাগ ভৌগোলিক অঞ্চল সমতল ও উর্বর মাটি হওয়ায় দেশটি একটি আঞ্চলিক কৃষি শক্তিতে পরিণত হয়েছে। দেশটি গম রপ্তাণিতে পৃথিবীর মধ্যে পঞ্চম এবং সরিষা ও সূর্যমুখির মত তেল বীজ রপ্তানিতে সর্ব প্রথম। খণিজ কয়লা, রাসায়নিক দ্রব্য, বিমান, ট্রাক্টর, লোকোমোটিভ, টার্বাইন ইত্যাদির যান্ত্রিক পার্টস এবং জাহাজ নির্মান ইউক্রেনের অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাত। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে, এ সব সম্পদ জবর দখল করার প্রত্যাশা থেকেই রাশিয়া মাঠে নেমেছে। অবশ্য সব কিছু নির্ভর করছে, যুদ্ধটা কোন পর্যায়ে শেষ হবে তার উপর। ইইউ ও যুক্তরাষ্টের হস্তক্ষেপে কোন উপায়ে যদি এক সময় যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়, আর তাতে যদি হাজার হাজার মানুষ নিহত ও আহত হয় সেক্ষেত্রে ইউক্রেন তেমন লাভবান হবে না।
বিশ্ব অর্থনীতিতে বৃহৎ পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতির বিস্তার লাভের ক্ষেত্রে এই যুদ্ধ একটি বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি অতিমারি কোভিড আঘাত হানার পূর্বেই প্রধান প্রধান পুঁজিতান্ত্রিক দেশগুলি মন্দার দিকে যাচ্ছিল।অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ এবং মূলধনের লাভজনকতা শূণ্যের কোঠায় নেমে যাচ্ছিল। তারপর সারা বিশ্বে সংক্রমণ বেড়ে গিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু মিছিল মহামারির মহামন্দার আবির্ভাব হল। বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলো তাদের সম্ভাবনাময় জাতীয় উৎপাদনের ৩% থেকে ৫% হারাতে বসল। ফলশ্রুতিতে পৃথিবীতে ১০ কোটির বেশি মানুষ চরম দারিদ্রের দিকে ধাবিত হয়েছে, যেখানে বিশ্বে ৪০ কোটি মানুষ বাস্তবতার সব সুচকে ইতিমধ্যেই দরিদ্র। এদিকে পশ্চিমা দেশের সকল আলোচনা অস্ত্রের মজুদ বাড়ানো এবং প্রতিরক্ষা নিয়ে, রাশিয়ার আগ্রাসন ঠেকানোর জন্য টাকা ঢালা এবং চীনের বিস্তারকে থামানোর জন্য ইউরোপ ও এশিয়া জুড়ে আমেরিকার সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব বাড়ানো। যার অর্থ হল, বন্দুকের জন্য অর্থ ব্যয় বাড়ানো এবং খাদ্যর জন্য অর্থ ব্যয় কমানো। তুলনামূলকভাবে যুক্তরাষ্ট্রর আধিপত্য হ্রাস পাচ্ছে। ইউরোপের পরে একুশ শতকে এর প্রতিযোগী দেশ যেমন- জাপান, চীনের উত্থানের সাথে সাথে প্রযুক্তি, ব্যবসা বাণিজ্য ও উৎপাদন খাতে যুক্তরাষ্ট্রর কর্তৃত্বর পতন ঘটেছে। কিন্তু তারা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বলয় ও বৃহৎ সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে তাদের কর্তৃত্ব ধরে রেখেছে।
No comments:
Post a Comment
to drop Your valuable Comment please mention your name (Click to arrow sign and select name/url)