’ভালবাসার সুরঙ্গ’- যেখানে দাঁড়িয়ে আলিঙ্গন করলে ভালবাসার বন্ধন কখনো ছিন্ন হবে না।
ইউক্রেনের ক্লেভান অঞ্চলে এমন একটি মনোমুগ্ধকর স্থান রয়েছে যা আপনাকে স্বপ্নের দেশে নিয়ে যাবে। আপনি হারিয়ে যাবেন কল্পলোকের ফ্যান্টাসিতে। ক্লেভান শহরের নিকটবর্তী ’ভালবাসার সুরঙ্গ’ এমনই একটি স্থান যেখানে রয়েছে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য ও মৌলিকত্ব। সারি সারি গাছ গোলাকার হয়ে রেললাইন ও খিলানের উপর দিয়ে উঠে গিয়ে পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সবুজ করিডোরের সৃষ্টি হয়েছে। গ্রীষ্ম ও শরৎকালে প্রকৃতি গাছের পাতাগুলোত সবুজ থেকে অবিশ্বাস্য রকম সোনালী ও রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। দিনের বেলায় সুরঙ্গের ভেতর আলো ছায়ার এক অদ্ভুত রূপ তৈরী হয়।
পৃথিবীতে এই সুরঙ্গ পথটি আবিষ্কার হয় মাত্র দশ বছর আগে। প্রথম যখন এই সুরঙ্গটি আবিষ্কার হয় তখন ইন্টারনেটের কল্যানে এই জায়গার ছবি ফেসবুকে শেয়ার করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে অবিশ্বাস্যভাবে বিপুল পরিমান মন্তব্য জমা হতে থাকে। লোকজন তখন এই ছবিগুলোকে ফটোশপের বিস্ময়কর কারসাজি বলে মনে করেন। কিন্তু যে পর্যটক প্রথম এই জায়গাটিতে তার পদচিহ্ন রেখেছেন ও নিজের চোখে এই সৌন্দর্য উপভোগ করেছেন, তিনি সবার সব রকম সন্দেহকে উড়িয়ে দেন।
এই সুরঙ্গ সম্পর্কে অনেক মজার কিংবদন্তী প্রচলিত রয়েছে। এই সবুজ করিডোরের অস্তিত্ব কয়েক শতাব্দী ধরে । এক সময় এটা ইউক্রেনের ক্লেভান রাজপ্রাসাদ থেকে পালিয়ে আসা এক প্রেমিক যুগলের নিরাপদ আশ্রয় স্থান হয়ে ওঠে।
অন্য একটি জনশ্রুতি আরো বেশি মজার। পলিশ একজন প্রকৌশলী ক্লেভানের একজন তরুণীর প্রেমে পড়ে। তিনি বাস করতেন ওরজেভ অঞ্চলে। ওরজেভ থেকে ক্লেভানে তার প্রেমিকার কাছে যাওয়ার পথ সংক্ষিপ্ত করার জন্য তিনি জঙ্গলের মধ্য দিয়ে এই রেলপথ তৈরী করেন। যদিও তারা আসা যাওয়ার জন্য ভিন্ন ভিন্ন রাস্তা ব্যবহার করতেন। স্থানীয় জনসাধারণ বলেন, তাদের এই ভালবাসার বন্ধন সারা জীবন ধরে অটুট ছিল।
কিন্তু সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মত হলো, এই রেলপথটি সোভিয়েত আমলে সামরিক উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়। এবং গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য গাছপালা লাগিয়ে রেলপথটি ঢেকে দেওয়া হয়। সময়ের পরিক্রমায় মিলিটারিরা চলে যায় এবং নির্জন প্রকৃতি এখানে পড়ে থাকে। তখন থেকেই প্রকৃতি তার অনন্য মহিমায় খিলানের কাঠামোর সুরঙ্গটিকে একটি আলৌকিক বিষয়ে পরিণত করে । যখন ওরজেভ থেকে এই রেলপথের উপর দিয়ে মালবাহী ট্রেন চলাচল করত তখন ট্রেনের সাথে সুরঙ্গের দুই পাশে থাকা ডালপালাগুলোর ধাক্কা লেগে গাছপালাগুলোর এই অনন্য আকৃতি তৈরী হয়।
সবুজ এই টানেলের পেছনে একটি রোমান্টিক ইতিহাস থাকলেও এর চারপাশে অস্বাভাবিক রকমের আলৌকিক আভা ছড়িয়ে আছে। এমন একটা পরিবেশ যেখানে স্বপ্নর বাস্তবায়ন হয়ে দুজনের হৃদয়ের একাত্মতা ঘোষণা করে। সবুজ খিলান এই আলৌকিক জ্যোতির প্রকাশ করে এবং এই রেলপথ দুটি বহমান জীবনের একই পথের প্রতীক। সুরঙ্গ পথটির বিশেষত্ব নিয়ে মানুষজনের মধ্যে নানান রকম বিশ্বাস প্রচলিত আছে। প্রেমিক যুগলরা বিশ্বাস করেন যে, এই সুরঙ্গর ভেতরে দাঁড়িয়ে চুমো খেলে তাদের জীবনে ভালবাসার বন্ধন দৃঢ় হবে এবং রেলের উপর দাঁড়িয়ে তারা যদি পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে তাহলে তারা জীবনে পরস্পর থেকে কখনো আলাদা হবেন না। এই টানেলটি নবদম্পতিদের কাছে বেশি জনপ্রিয়। নবদম্পতিরা এখানে এসে ছবি তোলেন এবং ফুলের চারা লাগিয়ে যান যা তাদের ভালবাসার গভীরতা ও নির্মল অনুভূতির প্রতীক বহন করে। এখানকার স্থানীয়রা মনে করেন নব দম্পতিদের জন্য ভালবাসার সুরঙ্গ ভ্রমন করা তাদের জীবওন শুভ লক্ষণ বয়ে আনে এবং বছরে অন্তত একবার তাদের এখান থেকে ঘুরে যাওয়া উচিৎ।
ভালবাসার সুরঙ্গ সম্পর্কে মজার কয়েকটি ঘটনা:
১) একটি বিখ্যাত ব্রান্ডের বিজ্ঞাপনে এই সুরঙ্গটি দেখা যায়। ২০১২ সালে জাপানি কোম্পানি ফুজিফিল্ম ৪০ সেকেন্ড এর একটি ভিডিও শ্যুট করে। যেখানে দেখা যায় একজন হঠাৎ করে একটি সবুজ দেয়াল থেকে সুরঙ্গের ভেতর পড়ে যাচ্ছে এবং সাথে সাথে নতুন একটি ক্যামেরা দিয়ে অসংখ্য মনোমুগ্ধকর ছবি ক্যামেরা বন্দী করা হচ্ছে।
২) কয়েক বছর আগে জাপানি একজন পরিচালক আকিওশি ইমাজাকি এই সুরঙ্গের ভেতর একটি ছবির চিত্রায়ন করেন।দুর্ঘটনাক্রমে ইন্টারনেটে একটি লিঙ্কের মাধ্যমে শ্যুটিং এর এই স্থান সম্পর্কে জানা যায়। ইমাজাকি সুরঙ্গের সৌন্দর্য এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি ফিল্মের পুরো দলকে এখানে এনে একটা ছবি বানিয়েই ক্ষান্ত হননি, তিনি পরবর্তীতে তার ছবির নাম পাল্টে নতুন নাম দেন, “ভালবাসার সুরঙ্গ- ক্লেভান। ২০১৫ সালে হ্যানয়ের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটির প্রিমিয়ার প্রদর্শিত হয়। এরপর থেকে ইউক্রেনের এই স্থানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সম্পর্কে সারা বিশ্ব জেনে যায়।
৩) ২০১৭ সালের মে মাসে চীনের হেফেই শহরের নিকটে ভালবাসার সুরঙ্গ নামে একটি রোমান্টিক স্থানের উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ইউক্রেনের প্রতিনিধিগন উপস্থিত থাকেন। আকারে অনেক ছোট হলেও এই সুরঙ্গ ইউক্রেনের ভালবাসার সুরঙ্গের আদলে তৈরী করা হয়েছে।
৪) ক্লেভানের এই সুরঙ্গটি প্রায় সময়ই পৃথিবীর সবচেয়ে বিস্ময়কর রেলপথের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করে।
ছবি: গুগল
No comments:
Post a Comment
to drop Your valuable Comment please mention your name (Click to arrow sign and select name/url)